ফিরে আসে বারেবার।
লেখক : ফাতিমা পারভীন
হারজিত নিয়ে কখনো কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে বেঁচে থাকতে শিখিনি। মেয়েশিশু হয়ে পৃথিবীতে আসার পর এক অন্যরকম উদাসীনতার মধ্যে বড় হতে হয়েছিল। আমার প্রতি নেতিবাচকতা, নিষ্ঠুরতা, শঠতা আর প্রতারণা আমাকে খুব বেশি আড়াল করে রাখতে পারেনি। বরং এসবের আড়ালে আশ্রয় গ্রহণ করে মানুষ হতে চেষ্টা করেছি। চাইলেই জীবনের কিছু বাস্তবতা ও নিয়তির নির্মমতা ইগনোর করা যায়না। শিশুকাল থেকেই ডিপ্রেশনে ভূগতাম। পরবর্তী অসহনীয় জীবনের কথা কখনো কারো সাথে শেয়ার করতে পারিনি কারণ পাশে কেউ সমালোচনা করবে সেই ভয়। আজ আর ওইসব ভয় নেই বরং পিছিয়েপড়া নারী জনগোষ্ঠীর একদম পিছনের সারির শেষ মানুষটি ছিলাম আমি ওই কথা ভেবে আজ দুঃসময় গুলোর কথা মনে করে হতবাক হই। বিষখালি নদী ছিল খুব নিকটে মনে পড়ে একাকী নদীর তীরে বসে কত জল আর ঢেউ দেখেছি। ওই নদী আমাকে অনেক উদার হতে শিখিয়েছে চারপাশের কার্পণ্যতা ভুলিয়ে দিয়েছে। হয়তো আজও মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি তাই বলে যে একদম অমানুষ হয়ে যায়নি তাও খুব বুঝতে পারছি। নদীর তীরে ঢেউ দেখতাম। ভিজতাম ভাল লাগতো। জমে থাকা বালু দিয়ে হরেক রকম ঘরবাড়ি তৈরি করতাম। বালু দিয়ে তৈরি ঘরগুলো দেখতাম নীরবে। ভালোলাগা ছিল বেশ। নিজের হাতে তৈরি করা ঘরগুলো যখন নদীর ঢেউয়ের পানিতে ভেঙে ফেলত তখন মন খারাপের দেশে চলে যেতাম। তখনই বুঝেছিলাম জীবনটাও ঠিক এমনই। গড়ে আবার ভাঙ্গে। ভাঙ্গে আর গড়ে ওঠে না। জীবন সত্যিই রহস্যাবৃত। মেয়েশিশুদের কালেভাদ্রেই সুখ আসে, আদর যত্ন বলতে একালের মেয়েশিশু যা পায় এরকম নয়। মনে মনে চাইতাম ঘুম থেকে উঠেই যেন ছেলে শিশু হয়ে যাই। প্রতিদিন সকালে নিজেকে খুব অসহায় লাগতো। আমরা অনেক ভাইবোন ছিলাম তাই সবার প্রতি খেয়াল রাখা একজন মানুষের জন্য সম্ভব নয়। বুঝতাম না। সেদিনের মায়ের প্রতি সেই অভিমান থেকে আজ বেশ বুঝতে পারছি। আর বোঝার একমাত্র কারণ হলো আজ আমিও একজন “মা”।
চারপাশে নিষ্ঠুরতা দেখে যুদ্ধ করতে শিখেছিলাম। আমার ভালো লাগা ভালোবাসা আর বেঁচে থাকা যাই বলি না কেন সবকিছুই যেন এই বিষখালী নদী নিয়ে। কত সময় কাটিয়েছি নদীর তীরে। এটা ছিল আমার শৈশবের নদী। নদীর পাড়ে একটা মস্ত বড় বটগাছ ছিল। আমরা সব বন্ধুরা মিলে ওই বটগাছটায় বেশ চড়তাম। ছোঁয়া ছোঁয়া খেলতাম। এডাল থেকে ওডালে ছোটাছুটি করতাম। একটা মজার পৃথিবী ছিল। যা আজকালকার ছেলেমেয়েরা একদম পায়না। খোলা আকাশ ও মাঠ ছিল আর ছেলেবেলার এক মহান স্বাধীনতা ছিল। বাড়িতে একটা বড়সড় জবাবদিহিতা ছিল। বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল। প্রতিবেশীরা একে অপরের সহায়ক ছিলেন। সন্ধ্যা হলেই নীড়ের পাখিরা ঘরে ফিরতো। আমরাও ফিরতাম। মাগরিবের আযান মানে বাইরের জগৎ বন্ধ নামাজ আদায় করে লেখাপড়া করতে হবে। ওই সময়ে ছেলে আর মেয়ে মস্ত এক বিভেদ ছিল। মার্বেল খেলা, রিং ঘোরানো, দাঁড়িয়াবান্ধা, সাইকেল চালানো এগুলোর অধিকারী ছেলেরা। আমার সেঝ বোন আমাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে ছেলেদের সাথে মার্বেল খেলতো, সাইকেল চালাতো। আমিও বঞ্চিত হইনি। মনে পড়ে তখন সম্ভবত দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি একদিন আমরা তিনবোন মিলে গভীর রাতে খেজুর রস চুরি করলাম। আমাদের সাথে ছিলেন আরো কয়েকজন। মানে আমার বড় বোনদের বন্ধুরা। এখনো তাদের নাম ভুলিনি। জেসমিন আপু ও তার ভাই মাসুম ভাইয়া দুজনে মিলে নারিকেল নিয়ে আসেন। লিনা,লুনা ও রুমা আন্টি তিনবোন মিলে পাতিল আর চাউল। আমরা তিন বোন খড়ি ও খেজুর রসের ব্যবস্থা করবো। সবাই মিলে আগের দিন বিকেলবেলা ঠিক করা হলো রাত তিনটায় একত্র হবো। তারা সবাই আমাদের বাসার সামনে এসে টিনের চালে ঢিল মারলেই আমরা বাসা থেকে বের হবো,যেই কথা সেই কাজ। আমি একটু ঘুম কাতুরে ছিলাম কিছুতেই উঠতে পারছিলাম না সেজো বোন আমাকে চিমটি কেটে ঘুম থেকে উঠালো। আমাকে চিমটে কাটার সময় মায়ের ঘুম ভেঙে ছিল কিন্তু আমরা টের পাইনি। মা ছিলেন অত্যন্ত চতুর আর বুদ্ধিমান। তিনিও চুপিচুপি উঠছেন কি করবে গভীর রাতে তার দস্যি মেয়েরা দেখার জন্য। মহাযজ্ঞটি সমাপ্ত করতে উদ্যত হলাম। আমাদের তিন বোনের উপরে দায়িত্ব পড়লো রসের ব্যবস্থা করা। আমাদের বোনদের কাণ্ডটি মা দূর থেকে দেখেছিলেন আর রাগে জ্বলছিলেন। মা ইচ্ছে করলেই আমরা যখন খেজুর-গাছের-রস নামাচ্ছিলাম তখনই ব্যবস্থা নিতে পারতেন কিন্তু আমার মা শেষ না দেখে ছাড়বেন না। পাঁচটি খেজুর-গাছের-রস সংগ্রহ করেছিল দুইবোন, আমি ছিলাম পাহারায়,রস দেখে হেসেছিলাম, হাসার জন্য চড় খেতে হয়েছিল। আনন্দের পরে যা হবার তাই হলো। অভিমানী আমি নালিশের জন্য রওনা হতেই আমাকে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে মায়ের শাসনের কথা মনে করিয়ে দেয় অন্য বোন। অনেক কষ্ট করে তিনবোন মিলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস এর একটি ভাঙ্গা রুমের মধ্যে নিয়ে গেলাম। রসের পরিমাণ দেখে সবার চোখ মাথায়,যেন ডাকাতি করে ফিরেছি। রস পাতিলে রাখতেই ধড়াম ধরাম করে আমার ও আমার বোনদের পিঠে কে যেন মারলো লাঠি দিয়ে। আঘাত পেয়ে প্রথমে কিছু বুঝতেই পারিনি পরে মায়ের বকুনিতে আমরা তিন বোন ছাড়া সবাই লাপাত্তা। অবশেষে বুঝলাম এতক্ষণে রক্ষণশীল জননী আমার শীতের এই রাতে তার দস্যু কন্যাদের দেখার জন্য কত অধ্যাবসায় চালিয়ে ছিলেন।ওই রাতে মা শুধু আমাদের শাসনই করলেন না, সকালে খেজুর রসের মালিকের কাছে রস ফেরতসহ আমাদের ক্ষমা চাওয়ালেন। আমরা সেদিন অনেক লজ্জিত ছিলাম কিন্তু মায়ের সেদিনের আবেদনময়ী বর্ণনা জীবনে কোনোদিনও ভুলতে পারবো না। মা এমন করুণ আবেদনময়ী বর্ণনা করেছিলেন প্রতিবেশী আব্দুর রশিদ চাচার কাছে তা আজো ভুলতে পারিনি। মনে হয়েছিল আমাদের তিনি মানুষ করতে পারেন নি। আমাদের তিন বোনের কাণ্ডটি মায়ের মুখে শুনে চাচা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু আমার মা কিছুতেই সহজ করে বিষয়টি মেনে নিতে পারছিলেন না এমনকি চাচাকে খেজুর রস গ্রহণ করাতে বাধ্য করেছিলেন,আমরা অনেক লজ্জিত হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, সেদিনের মায়ের শাসন আমাকে কতটা শিক্ষা দিয়েছিল। অন্তরে মানবিকতার হৃদয়বৃত্তি জাগ্রত হয়েছে। পাপ-পূণ্য ও ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা দিয়েছিলেন আমার মা।
লেখক শিশু ও নারী অধিকার কর্মী
fatimaparvin2013@gmail.com