গল্পজানালাবাংলাদেশ

প্রতিবন্ধী লিপিরানীর সেলাই ঘর

কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নেয়ামতপুর গ্রামের গৃহবধূ লিপিরানী। বয়স ৩০ বছর। লিপিরানী শারিরীক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। তিনি নিজ চেষ্টায় প্রতিকূলতাকে জয় করে সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছেন। তার সংসার বিমুখ স্বামীকে নিজেই দক্ষতাবৃদ্ধি করে নিজের কাজের অংশীদার করেছেন।

এত সুন্দরভাবে তার জীবন শুরু হয়নি। ১৩ বছর আগে কৃষিশ্রমিক সুশান্ত সরকারের সাথে তার বিয়ে হয়। প্রতিবন্ধীতার কারনে লিপিরানীর বাবা ইংরেশ্বর সিকদার নতুন জামাই সুশান্তকে ছোট-খাটো ব্যবসার জন্য ৩০ হাজার টাকা প্রদান করে। এ টাকা দিয়ে গ্রামের মধ্যে তেমন কোন ব্যবসা করতে পারেনি সুশান্ত। এদিকে বিয়ে পরবর্তী খরচ মেটাতে টাকাটাও শেষ হয়ে যায়।

এরপর থেকে অভাবের সংসারে খেয়ে নাখেয়ে থাকতে হত লিপিরানীকে। প্রতিবন্ধীতার কারনে পরিবারের অন্যদের গালমন্দ শুনতে হতো নিয়মিত। স্বামী সুশান্ত বাউন্ডেলে। কির্তন দলের সাথে মাসের পর মাস এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতো। সংসারের প্রতি তার কোন টান নেই, নেই কোন দায়িত্ব। প্রতিবন্ধী স্ত্রীকে সে গলার কাঁটা মনে করতো। প্রতিবন্ধী নারী বিয়ে করায় সমাজিকভাবে তিনি ছোট হয়েছেন বলে নিজেকে মনে করতেন আর সেই দায় তিনি নিজের স্ত্রীর উপর আরোপ করতেন। এজন্য প্রায়ই সুশান্ত ছোট-খাটো ত্রæটি ধরে স্ত্রীকে গালাগাল দিতো। পরিবার, স্বামী, প্রতিবেশীদের খারাপ আচরণের কারনে লিপি রানী নিজেকে অপাংতেয় ভাবতে শুরু করে। ইতিমধ্যে পরিবার থেকে আলাদা করে লিপি রানীকে বাড়ির পিছনের দিকে খালের পাড়ে নির্জন জায়গায় ছোট্ট একটি ঘর তৈরি করে সেখানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এবারে শুরু হয় তার একাকী জীবন। স্বামী দূরে গেলে তার কোনরকম খেয়ে-নাখেয়ে দিন কাটতে থাকে। এরই মাঝে তাদের সংসারে আসে ক্রমান্বয়ে দুই মেয়ে। দিশেহারা হয়ে পড়েন লিপি রানী। প্রতিবন্ধী লিপি রানীর বাড়ি থেকে বেড় হয়ে দূরে কিছু করার সামাজিক বাধা আছে। তার উপর তার জন্য করার মত তেমন কোন কাজ আছে কিনা তা তার জানা নেই। দু:সহ যন্ত্রনার মধ্যে দিন কাটতে থাকে তার। এদিকে ধীরে ধীরে তাদের মেয়েরা বড় হতে থাকে। অভাব অনটনের সংসারে দু’বেলা খাবার জোগানোই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

সিডিডি’র সহযোগিতায় স্থানীয় বাস্তবায়নকারী সংস্থার মাধ্যমে মার্চ ২০১০ সনে নীলগঞ্জ এলাকায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য পরিচালিত পিএইচআরপিবিডি প্রকল্প শুরু হয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে এই প্রকল্পের কাজ। পাখিমারা গ্রামের প্রতিবন্ধীব্যক্তি সুমন দেরীর মাধ্যমে এই তথ্যটি লিপি রানীর কাছে পৌঁছায়। লিপি রানীর জীবনের সমস্যায় কারো সহযোগিতা না থাকায় সে খুব ভেঙ্গে পড়েছিলো। তাই প্রতিবন্ধী এক ভাইয়ের আহŸানে সে তাৎক্ষণিক সাড়া দিয়ে এই প্রকল্পের আশার আলো স্ব-সংগঠনের সদস্য হয়। এখানে সে এক নতুন জীবন খুঁজে পায়। সমমনা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাথে মিলিত হয়ে তার কষ্টের কথা ব্যক্ত করার একটি জায়গা তৈরী হয়। পাশাপাশি সহমর্মী মানুষগুলোর আশ্বাস-বিশ্বাস তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। শুরু হয় তার নতুন পথে পথচলা। আশার আলো স্ব-সংগঠনের কিছুদিনের আলাপ-আলোচনায় সে বুঝে নেয় এটাই তার সঠিক পথ। সে নিয়মিত সভায় উপস্থিত হয় এবং প্রতিবন্ধীতা সম্পর্কে ধারণা নেয় আর বাঁচার স্বপ্ন দেখে। পিএইআরপিবিডি প্রকল্পের মাধ্যমে সে সিডিডিতে অধিকার ও নেতৃত্বের উপর ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ পায়। এরপর আর লিপিরানী নিজেকে আড়ালে গুটিয়ে না রেখে সংগঠন এবং বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত হতে থাকে। তার বাচনভঙ্গি, নিজেকে উপস্থাপন করার ব্যাপারে সচেষ্ট হয়। তার সবকিছুই পাল্টে যেতে শুরু করে।

আশার আলো স্ব-সংগঠনের কমিটি তাদের সদস্যদের নানা রকমের সুবিধা পাইয়ে দেয়ার ব্যাপারে পরিকল্পনা করে কর্মকান্ড গ্রহন করে। এই কমিটির সহায়তায় লিপিরানী ২০১২ সনে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একমাসের সেলাই প্রশিক্ষণ পায় এবং ১২টি সেলাই আইটেম সে রপ্ত করে। কিছু টাকা এনজিও ঋণ নিয়ে একটি সেলাই মেশিন ক্রয় করে। সে তার বাড়ির সামনে লিপি টেইলার্স নামে একটি সাইনবোর্ড দিলেও তেমন কেউ সাড়া দিচ্ছিলো না। কারন প্রতিবন্ধীতার জন্য সে ইতিমধ্যেই আশপাশের পরিবারগুলোর কাছে অগ্রহনযোগ্য ছিল। তাছাড়া নিজের পরিবার যেখানে তাকে দূর করে দিয়েছিলো সেখানে প্রতিবেশীরা জামা-কাপড় বানাতে দিয়ে শুধুশুধু ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছিলো না। এ এক নতুন চ্যালেঞ্জ। সাংগঠনিকভাবে দক্ষতা অর্জিত হওয়ায় সে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার ব্যাপারে সক্ষম ছিলো। প্রথমে লিপি রানী আশপাশের বাড়িগুলোতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক যোগাযোগ শুরু করে এবং সফলতার সাথে বুঝাতে সক্ষম হয়। দু-একটি কাজ পাওয়া শুরু হয়। গুণগতমান ও কাজের নান্দনিকতা দেখে নারী ও শিশুদের পোষাকের অর্ডার নিয়মিত আসতে থাকে। ঘরের মিটমিটে হেরিকেনের আলোতে লিপি রানী রাতভর সেলাই করতে থাকে। আর নতুন স্বপ্নে সকালের ঝলমল রোদে জীবনকে সাজাতে থাকে।

ছয় মাসের ব্যবধানে তার নতুন উন্নতি তার স্বামীর কাছে আশার সঞ্চার করে। এবারে লিপির ঘরছাড়া স্বামী ঘরে এসে লিপির পাশে দাড়ায়। টুকটাক পরিবারের কাজে সহযোগিতা করে আর সন্তানদের দেখাশুনা করে। রাতে যখন স্বামী সুশান্তর হাতে কাজ থাকেনা তখন সে লিপি রানীর সেলাই করা পোষাকের হাতের কাজ করার চেষ্টা করে। শিখে নেয় অল্প দিনে। এভাবে সেলাই কাজও শেখে লিপি রানীর কাছে। এবার আর একটি মেশিন ক্রয় করে। শুরু হয় লিপি দম্পতির সেলাই ঘরের মিলেমিশে পাশাপাশি থেকে একসাথে কাজ। শক্ত হয় স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন। ভালোবাসায়, আনন্দে, স্বাচ্ছন্দে লিপি পরিবারের সন্তানরা আলোকিত জীবনের স্বাদ পেতে থাকে।

দু’জনের অক্লান্ত চেষ্টায় সেলাই কাজ বেশ এগিয়ে যাচ্ছিলো। এবার শুধুমাত্র সেলাই নয়, লাভের অংক বাড়াতে তারা সেলাই ঘরে লাভের কিছু টাকা দিয়ে কাপড় তুললো। কাজের কমতি সময়ে নারীদের পেডিকোট ও ব্লাউজ রেডিমেট তৈরী করে। এই পোষাক সুশান্ত ব্যাগে পুরে পাশের গ্রামে হেটে বাড়িতে গিয়ে বিক্রি করে। এতে লাভ কম হলেও বাড়তি টাকা আসে। পাশের বাড়ির স্কুল পড়–য়া মেয়েদের লিপি কাজ শিখিয়েছে। ঈদ, পূজা ও ধান ওঠার মৌসূমে বিশেষভাবে কাজ বেড়ে যায়। স্বামী সুশান্ত’র পাশাপাশি লিপির শেখানো মেয়েরা তাকে সহযোগিতা করে। লিপি তাদেরকে লাভের কিছু অংশ দেয়। এই টাকা দিয়ে ওদের পড়াশুনায় ব্যয় করে তাদের পরিবারের বোঝা হালকা করতে পারছে। ফলে লিপির সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী বিষয়ে মানসিকতা কিছুটা হলেও ইতিবাচক হচ্ছে।

শুধুই সেলাই নয়। লিপি তার ছোট্ট বাড়িটাকে সাজিয়েছে। এক কোনে রোদ্রোজ্জ্বল জায়গাটুকুতে নার্সারী করেছে। ফল ও বৃক্ষ চারা তৈরী করে বিক্রি করছে। বছরান্তে এখান থেকেও বেশ কিছু টাকা ঘরে তুলতে পারছে। তাছাড়া তার ফলের চারা গ্রামের নারীরা পোষাকের অর্ডার দিতে এসে কিনে নিয়ে যায়। বাড়িতে নানা রকমের ফলের গাছ রোপন করেছে। লিপির বাড়িতে সফেদা, বাতাবী লেবু, ডালিম, আমড়া, কতবেলসহ নানা ফলের গাছে ভরপুর। ফল বিক্রি করেও টাকা আয় হচ্ছে।

লিপি দম্পতির মাসিক আয় এখন ৮০০০ টাকার মত। সাংসারিক খরচ মিটিয়ে যা থাকে তার সাথে নার্সারী ও ফলবিক্রি টাকা মিলিয়ে বছরে অন্তত ২০,০০০ টাকা সাশ্রয় হয়। ঘরে টিন দিয়েছে এবং বাড়ান্দা সম্প্রসারণ করেছে। ১০ শতাংশ জমি কিনেছে। পাকা লেট্রিন করেছে। খাবার পানির খুব অভাব তাই বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং তৈরি করেছে। অবশ্য এসব ব্যাপারে বিভিন্ন এনজিও’র সাথে যোগাযোগ করে লিপি কারিগরি সহায়তা নিয়েছে। লিপির আয় যেমন দিনে দিনে বাড়ছে, তেমনি তার পরিবার বছর বছর সমৃদ্ধ হচ্ছে। তার মেয়েরা পড়াশুনা করে সম্ভাবনার ভীত গড়ছে।

একজন অসহায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় লিপি রানী আজ নিজেই তার ব্যবসায় নির্দেশনা দিচ্ছেন। পরিবারের আয়-ব্যয় হিসাব করছেন। সাশ্রয় নিজের কাছে জমা রাখছেন। সংসার পরিচালনায় ভূমিকা রাখছেন। স্ব-সংগঠনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যেখানে তার মেয়েরা পড়াশুনা করছে সেই স্কুল কমিটির সভায় মতামত রাখছেন। ইউনিয়ন পরিষদে বিভিন্ন সভায় অংশগ্রহন করছেন। স্ব-সংগঠনের হয়ে উপজেলায় কর্মকর্তাদের সাথে প্রতিবন্ধীতা নিয়ে কথা বলছেন। দিবস উদযাপনে বক্তব্য রাখছেন। তিনি এপেক্সবডির সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সেখানে কৌশলগত পরিকল্পনা করছেন এবং তা বাস্তবায়নে অবদান রাখছেন। তার প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে তিনি সক্ষম হয়েছেন।

এখন লিপি রানীর সংসারে সচ্ছলতা এসেছে। যে শাশুড়ী তাকে আলাদা করেছিল, তার কাছে লিপি রানী এখন লক্ষীবউ। পরিবার ও সমাজে গ্রহনযোগ্যতা বেড়েছে। লিপি টেইলার্স এখন সবার কাছে অতি পরিচিত একটি নাম। সংগ্রাম ৬ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে দশজন সফল সদস্যকে সম্মাননা প্রদান করে। লিপি রানী তার সফলতায় যোগ্য বিবেচিত হয়ে এই সম্মাননাপ্রাপ্ত হয়েছেন। লিপি রানী মনে করেন ‘স্বাবলম্বীতা অর্জনে প্রতিবন্ধীতা কোন বাধা নয়। চেষ্টাই সফলতার মূল চাবিকাঠি।’

Back to top button

এড ব্লক এল্যার্ট

আমাদের সাইটি ভিজিট করতে দয়া করে আপনার ব্রাউজারের এড ব্লক এক্টেনশনটি বন্ধ করুন।