নিউজ ডেস্ক,
বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজে হাইকোর্ট ও সুপ্রীমকোর্টের আদেশ অমান্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ৯ জন শিক্ষকের অবৈধ পদোন্নতির মাধ্যমে কোটি টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। সূত্র মতে, ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর পরিচালনা পর্ষদের ৩৯ তম সভায় ৪ নং আলোচ্য বিষয় স্থায়ী শিক্ষকদের পদোন্নতির বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ অন্তর্ভুক্ত করে সভায় ৯ জনকে প্রভাষক পদ থেকে সহকারী অধ্যাপক এবং একজনকে প্রদর্শক পদ থেকে প্রভাষক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। রেজুলেশনের আলোচ্যসূচি ৪ এ উল্লেখ করা হয় প্রতিষ্ঠানের ৯ জন প্রভাষক এবং একজন প্রদর্শক এর পদোন্নতির বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনান্তে আবেদনকৃত ৯ জন প্রভাষককে সহকারী অধ্যাপক পদে এবং একজন প্রদর্শককে প্রভাষক পদে তাদের চাকরিতে যোগদানের জেষ্ঠতার ক্রম অনুযায়ী পদোন্নতি প্রদানে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়। যারা অবৈধভাবে এ পদোন্নতি পেয়েছেন তারা হলেন মাজেদা খাঁন, প্রভাষক প্রাণিবিদ্যা থেকে সহকারী অধ্যাপক প্রাণিবিদ্যা। মোহাম্মদ আবু মামুন, প্রভাষক গণিত থেকে সহকারী অধ্যাপক গণিত। এস এম মাঈনুদ্দিন, প্রভাষক বাংলা থেকে সহকারী অধ্যাপক বাংলা। মোঃ হুমায়ুন কবির, প্রভাষক পদার্থবিদ্যা থেকে সহকারী অধ্যাপক পদার্থবিদ্যা। মোঃ সিরাজুল ইসলাম, প্রভাষক হিসাববিজ্ঞান থেকে সহকারী অধ্যাপক হিসাববিজ্ঞান। মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ, প্রভাষক অর্থনীতি থেকে সহকারী অধ্যাপক অর্থনীতি। অলোক কুমার সরকার, প্রভাষক ব্যবস্থাপনা থেকে সহকারী অধ্যাপক ব্যবস্থাপনা। মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল, প্রভাষক আরবী থেকে সহকারী অধ্যাপক আরবি। এম সাজ্জাতুল ইসলাম, প্রভাষক বাংলা থেকে সহকারী অধ্যাপক বাংলা পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ২০১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আপীলের রায় বাস্তবায়ন সমীচিন হবে বলে সভায় অভিমত ব্যক্ত করা হয়। রায়ে নয়টি মডেল স্কুল এন্ড কলেজে রিট আবেদনকারীদের নিয়োগ দেওয়ার পূর্বে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রদান করা যাবে না মর্মে আদেশ দেওয়া হয়েছে। একই সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঢাকা মহানগরীসহ ৬টি বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক মডেল বিদ্যালয় স্থাপন শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় প্রতিষ্ঠিত মডেল স্কুল এন্ড কলেজ সমূহের সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ সংক্রান্ত রিট পিটিশন ৪১২৫/২০০৮ এবং সিপি ৩৮৭/২০১০ এর রায়ের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিলের রায় বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রায়ে উল্লেখ করেন- ৯টি মডেল স্কুল এন্ড কলেজে সহকারী অধ্যাপক পদে নতুন কোন নিয়োগ প্রদান করা যাবে না। ৯ টি মডেল স্কুল এন্ড কলেজে প্রভাষক পদ থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে কাউকে পদোন্নতি দেওয়া যাবে না। সহকারী অধ্যাপক পদ গুলোকে শুধুমাত্র রিট পিটিশনকারীদের নিয়োগ প্রদান দ্বারা পূর্ণ করতে হবে। সুত্র জানায়, বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজে ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর ৯ জন শিক্ষক প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে নাকি ১৮ লাখ লাখ টাকা ঘুষ বানিজ্য হয়েছিল বলে গুঞ্জন ওঠে ওই সময়। পদোন্নতির পুর্বে এ ৯ জন শিক্ষকের ৯ম গ্রেডে বেতন স্কেল ছিল ২২০০০-৫৩০৬০। পদোন্নতির পরে তাদের ৬ষ্ঠ গ্রেডের বেতন স্কেল হয় ৩৫৫০০-৬৭০১০। অবৈধভাবে পদোন্নতি নিয়ে এই ৯জন শিক্ষক অতিরিক্ত প্রায় কোটি টাকা কলেজ ফান্ড থেকে উত্তোলন করেছে। এ ব্যাপারে ট্র্যান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল (টি আইবি)বরিশালের সভাপতি প্রফেসর শাহ সাজেদা বলেন, মহামান্য কোর্টের রায় এবং শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের আদেশ উপেক্ষা করে ৯ জন প্রভাষক পদ থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি সম্পুর্ন বেআইনী ও অনৈতিক। তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের উচিৎ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, কিভাবে এ পদোন্নতি পায়। এ পদোন্নতি অবৈধভাবে অর্থ আত্মসাতের জন্য হয়েছে। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, কেউ আইনের বাইরে কিছু করতে পারেনা। এখানে আইনের বাইরে গিয়ে পদোন্নোতি দেয়া হয়েছে, যা অনিয়ম ও দুর্নীতির শামিল। এ ব্যাপারে বরিশাল বারের সদস্য এ্যাডভোকেট শাহে আলম জানান, ৯ জনের পদোন্নতি সম্পুর্ন বেআইনী, অবৈধ ও অনৈতিক। এ অবৈধ পদোন্নতির পরে কোন সুবিধা ভোগ করলে অর্থসহ সেসব সুবিধা কলেজ কর্তৃপক্ষকে ফেরত দিতে হবে। অর্থ ফেরৎ না দিলে দুদক ও শিক্ষামন্ত্রনালয়ের উচিৎ হবে তাদের আইনের আওতায় আনা। এ ব্যাপারে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়া ও শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে পরিচালনা পর্ষদের সদস্য আবু মামুন বলেন, মহামান্য হাইকোর্ট ও সুপ্রীমকোর্টের রায়ের বিষয়টি আমি জানি। তবে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সভার বিষয় এবং সভার সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমার জানা ছিল না। তিনি বলেন, পরিচালনা পর্ষদ সর্বোচ্চ পর্ষদ, তারা পদোন্নতি দিয়েছে। তিনি ঘুষ বানিজ্যের অভিযোগ অস্বীকার করেন। এ ব্যাপারে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়া মাজেদা খান বলেন, আমাদের পরিচালনা পর্ষদ পদোন্নতি দিয়েছে। আমি এর বাইরে কিছু জানিনা। মিটিংয়ে আছে বলে কল কেটে দেন। এ ব্যাপারে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়া মোস্তফা কামাল প্রতিবেদককে বলেন, পদোন্নতিটা সহজ ছিলনা। টাকা তো খরচ হয়েছে। তবে কত টাকা খরচ হয়েছে সে বিষয় তিনি এড়িয়ে যান। এ ব্যাপারে বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মেজর সাহিদুর রহমান মজুমদার বলেন, মহামান্য হাইকোর্ট, সুপ্রীমকোর্টের রায় অমান্য এবং শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে শিক্ষকদের পদোন্নতির বিষয়টি আমার যোগদানের পূর্বে হয়েছে। তবে কিভাবে তাদের ৯ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, বিষয়টি আমি দেখেছি। অধ্যক্ষ বলেন, বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রনালয়কে অবহিত করবো। শিক্ষা মন্ত্রনালয় যে সিদ্ধান্ত দিবে সেটা আমি বাস্তবায়ন করবো। তিনি আরো বলেন, তাদের উচিৎ অতিরিক্ত টাকা ফেরৎ দেয়া। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন ‘ঢাকা মহানগরীসহ ছয়টি বিভাগে এগারটি উচ্চ মাধ্যমিক মডেল বিদ্যালয় (বেসরকারি) স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি ১৯৯৯ হতে শুরু হয় ২০০৮ সালে সমাপ্ত হয়। প্রকল্পের আওতায় নির্মিত ১১ টি মডেল স্কুল ও কলেজ এর মধ্যে দুইটি বিয়াম ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। বাকি ৯টি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গভর্নিং বডির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের যাবতীয় কার্যক্রম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক অনুবিভাগ থেকে সম্পূর্ণ হয়। ২০১৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারি ঘোষনা করা হয়। ২০২০ সালের ১৯ জুলাই তিনটি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আত্তীকরনের ফলে সম্পুর্নভাবে সরকারিকরন করা হয় বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ।