জানালাপাথরঘাটা

জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের শিশুরা।

লেখক : ফাতিমা পারভিন।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আমরা ভাবিনা অথচ সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ মস্ত সংকটে রয়েছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়,অতি খরা, অনাবৃষ্টি ও নদী ভাঙনের কারণে বাংলাদেশ আজ হুমকির মুখে। অরক্ষিত জলবায়ু পরিবর্তন খুব দ্রুত এই পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। স্থলসীমান্ত ঝুঁকির চেয়েও মানবসম্পদ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ আর বয়স্কদের তুলনায় শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় উপকূলীয় যেসব রোগব্যাধি দেখা দিচ্ছে তার প্রায় ৮৫ শতাংশই আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। সেই সঙ্গে শিশুদের মধ্যে পানি ও বায়ুবাহিত রোগ, অপুষ্টি, দুর্যোগকালীন মৃত্যু, শারীরিক ও মানসিক আঘাতের হার বাড়ছে। অপরদিকে ঘন ঘন বন্যার কারণে দীর্ঘ মেয়াদে শিশুদের স্কুল বন্ধ থাকছে। এতে করে অনেক শিশুর স্কুলে যাওয়া একেবারেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।  ফলে অলস সময় পার করতে হয় তাদের আর সেই কারণেই বেকার জীবনের স্বাদ গ্রহণ করে শিশুরা, এমতাবস্থায় শিশু শ্রমে জড়িয়ে যায় ওইসব শিশুরা। মেয়ে শিশুদের বেলায় আরো ঝুঁকি বহন করে। মেয়ে শিশুর নিরাপত্তার কথা ভেবে অভিভাবক সিদ্ধান্ত নেয় বিয়ের। তাতে বরের বয়স আর ভাবেন না। একজন পুরুষের হাতে তুলে দেয়াটাই সঠিক নিরাপদ বলে মনে করেন। বিয়ের কিছু দিন পর ওই শিশু বউয়ের শারীরিক গঠন ভেঙ্গে পড়ে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তাদের গর্ভে জন্ম নেয় অপুষ্টি শিশু। অপুষ্টি আর অকালে শারীরিক অবস্থার অবনতিতে বিভিন্ন অসুস্থতায় ভূগতে থাকে মা ও শিশু। একসময় পরিবারে নেমে আসে অশান্তি। মেয়ে শিশু আর মেয়ে শিশু থাকে না হয়ে যায় নির্যাতিত অবলা নারী। হতাশা ও বিষণ্নতায় ভূগে একদিন বেছে নেয় আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমাধান হয় তালাক মধ্য দিয়ে। হতাশ হবার বিষয় হলো যে, উপকূলীয় অঞ্চলের শিশুদের এভাবেই দিন দিন মৌলিক অধিকার খর্ব হচ্ছে, বিশেষ করে নিন্মবিত্ত পরিবারগুলোর। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সর্বজনীন সুযোগ, ক্ষুধা, দারিদ্র্য,অপুষ্টি,স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি ও শিশু বিবাহ এবং শ্রম বন্ধ দূরীকরণে বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক অর্জনগুলোকে হুমকির মুখে ফেলছে জলবায়ুর পরিবর্তন। এছাড়াও শিশুদের নির্ধারিত বয়স সীমার আগে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হওয়ার কারণে নানামুখী জৈবিক চাহিদা শুরু হয়, যার কারণে যৌনহয়রানি ও শিশু ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে শিশুরা। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধ্বংসী বন্যা, ঘূর্ণিঝড়,নদী ভাঙ্গন ও অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয়গুলো বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার শিশুদের জীবন ও ভবিষ্যতকে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে ফেলছে। যা বিশ্বের অন্য কোনো রাষ্ট্রে এতোটা বিরূপ প্রভাব পড়েনি। ছোটবেলায় যে ছয়টি ঋতু দেখে বড় হয়েছি, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেই ছয়টি ঋতু আজ বিলুপ্তির পথে। উপকূলীয় অঞ্চলে ঘটে যাওয়া আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়,সিডর,আইলা,মহাসেন,ফণি,মোরা, নার্গিস ও বুলবুল নামের ওই বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস, এবং অতি খরার মতো বিরূপ আবহাওয়াজনিত ঘটনার সম্মিলন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া ও নোনাপানির অনুপ্রবেশ,     জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত ঘটনাসমূহ উপকূলীয় পরিবারগুলোকে আরও বেশি দারিদ্র্য ও স্থানচ্যুতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। জোয়ার-ভাটার বিরুপ প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের বেরিবাঁধ ভাঙ্গনের কবলে পড়ে গ্রামাঞ্চলের পরিবারগুলো তাদের ফসলি জমি ও বাড়ি-ঘর হারিয়ে দিশেহারা হয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়, আর ওই স্থানচ্যুতির সম্পূর্ণ প্রভাব পড়ে শিশুদের উপর। তখন শিশুরা কার্যকরভাবে তাদের শৈশব হারায়। শহরে তারা বিপদ ও বঞ্চনার সম্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি শোষণ ও নিগ্রহের শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বাইরে কাজে যেতে চাপের মুখে পড়ে। রোগ আর ক্ষুধার সাথে যুদ্ধ করে যখন মৌলিক চাহিদা নস্যাৎ হয়, তখন শিশুদের নির্ধারিত অধিকার মিটিয়ে সামান্য একটু বেঁচে থাকার লড়াইয়ে চুরি আর অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে বিভিন্নমুখি অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে শিশুরা। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা শিশুদের ব্যবহার করছে সামান্য টাকার বিনিময়ে এমনকি মাদকদ্রব্য বহন করতেও বাধ্য হয় শিশুরা, আবার একসময় মাদকাসক্তও হয়ে পরে। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ওইসব শিশুদের শিক্ষা, মানবাধিকার, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বন্যায় বারবার বাড়ি ঘর ভেঙে যায় বলে হতদরিদ্র  পরিবারগুলো অধিকাংশই ঘর দুর্বল কাঠামোয় গড়ে তোলে, তাই বসবাসের পরিবেশ নেই বললেই চলে,তবু সেখানেই প্রজন্মের পর প্রজন্মের জীবন কেটে যায়। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও খরার মতো বিরূপ আবহাওয়াজনিত ঘটনার সম্মিলন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, নোনাপানির অনুপ্রবেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি ঘটনাসমূহ ওইসব পরিবারগুলোকে আরও বেশি দারিদ্র্য ও স্থানচ্যুতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ শিশুর বসবাস শক্তিশালী নদীপ্রবাহের পাশে। নদীগুলো বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নিয়মিতভাবে নদীর তীর ভাঙ্গে। তাই নিরাপদ পানির চাহিদা পূরণের জন্য নদী ও পুকুরের পানি যথেষ্ট অপরিহার্য নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো সুস্পষ্ট, যা সামঞ্জস্যহীনভাবে শিশুদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং নানামুখী অপরাধে অভিযুক্ত হচ্ছে তারা এমতাবস্থায় শিশুদের জন্য সহনীয় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাও অত্যন্ত জরুরি। সুশাসন ন্যায় পরায়ণ বিচারকার্য শিশুদের মানবিক গুণাবলী প্রতিষ্ঠা করবে বলে বিশ্বাস করি।অতি দ্রুত বিভিন্ন ধরনের দীর্ঘ মেয়াদে প্রকল্প গ্রহণ করে শিশুদের জীবনের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়ে প্রত্যেক শিশুকে তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী গড়ে তুলতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমাজে যে প্রকট বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে, তার সুরাহা না হলে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মুখ থুবড়ে পড়বে উজ্জ্বল একটি আগামীর ভবিষ্যত।

লেখক শিশু ও নারী অধিকার কর্মী

fatimaparvin2013@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

এড ব্লক এল্যার্ট

আমাদের সাইটি ভিজিট করতে দয়া করে আপনার ব্রাউজারের এড ব্লক এক্টেনশনটি বন্ধ করুন।